ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ারের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী কাল শনিবার

osman-1অর্পন বড়ুয়া,  :
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর, জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক, কিংবদন্তিতূল্য রাজনৈতিক অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী কাল শনিবার।

২০১০ সালের ২৭ আগষ্ট তিনি ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিসাধীন ছিলেন বরেণ্য এ রাজনৈতিক। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ রাজনৈতিকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো। যা আজো তাঁর আদর্শে দীক্ষিত অগণিত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধার অন্তর সে শোক ধারণ করছে। রামুর এ কীর্তিমান পুরুষের প্রয়াণে অনেকটা অভিভাবকশূণ্য হয়ে পড়ে কক্সবাজারের রাজনৈতিক অঙ্গন।

ঢাকা থেকে অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর মরদেহ আনা হয় রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মন্ডল পাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-জ্ঞাপনের জন্য তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজার স্টেডিয়ামে। লাখো মানুষের আঁখি জলে ভেজা পুষ্পতে সিক্ত হন জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক ওসমান সরওয়ার। সেখানে ওসমান সরওয়ারের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ঈদগাঁও কেজি স্কুল ও রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাযা শেষে অগণিত মানুষের পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে মন্ডল পাড়া পারিবারিক কবর স্থানে সমাহিত করা হয়। সেখানেই এখন শায়িত আছেন কিংবদন্তিতূল্য রাজনৈতিক ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী।

সফল রাজনৈতিক আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন। নারী ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার, সমাজসেবা আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। দূর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস আর দরিদ্র মানুষের দুর্দিনে নিজেকে উৎসর্গ করতেন ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী। অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। বর্ণিল কর্মময় জীবনের অধিকারী এ কীর্তিমান রাজনীতিককে তাই এখনো পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে কক্সবাজারসহ সারাদেশের আপামর জনসাধারণ।

মরহুমের পুত্র সাংসদ আলহাজ¦ সাইমুম সরওয়ার কমল জানিয়েছেন, শনিবার সকাল ১১টায় তাঁর বাসভবন ওসমান ভবনে খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সকলকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

১৯৩৭ সালের ১৮ অক্টোবর কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মন্ডল পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী। বাবা মালেকুজ্জামান সিকদার ও মা পরান সোনা। বাবা মালেকুজ্জামান ছিলেন ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন বোর্ডের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আজীবন প্রেসিডেন্ট ও সমাজকর্মী।

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৫৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন ওসমান সরওয়ার।

১৯৬১-৬২ ও ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রলীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ ভোটে যথাক্রমে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ডাকসু সহ-সভাপতি কে,এম ওবাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হয়ে গেলে হুলিয়া মাথায় নিয়ে ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী বাড়ীতে চলে আসেন। সেই অবধি সমাজের অলি গলির সাথে তাঁর পরিচয়ের পালা শুরু হয়।

ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মী। ছাত্রজীবন শেষে ১৯৬৩ সালে কক্সবাজারে তৎকালীন মুজিব ভাই এর হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সেই অবধি তিনি আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিত প্রাণকর্মী। দলকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি থেকে সমাজ কল্যাণ সম্পাদকের পদ নিয়ে নতুন লোক যোগদানের সুযোগ করে দেন। ১৯৬৫ সালে নিউক্লিয়ার্স গঠনের পর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত করার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেন। কিন্তু কক্সবাজার মহিলা কলেজ গড়ার স্বার্থে দু’হাত জোড় করে কাউন্সিল থেকে ক্ষমা চেয়ে সাধারণ সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। তখন কাউন্সিলারদের অনুরোধে তাঁর স্ত্রীকে জেলা আওয়ামীলীগের মহিলা সম্পাদিকা করতে সম্মতি দেন। তিনি মনে করতেন দলের জন্য কাজ করতে পদের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রামু থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। দু’টার্ম ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৯৬৩ সাল হতে স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যুতে কক্সবাজার জেলার যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, তিনি তার সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন। আয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলন, ফাতেমা জিন্নার নির্বাচন, ছয়দফা প্রচার, ‘৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি ’৯০ এর গণআন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার। এমন কোন মিটিং মিছিল কক্সবাজারে হয়নি যেখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল না।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি রামু উখিয়া টেকনাফ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কক্সবাজার জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক। হানাদার বাহিনী ৫ মে কক্সবাজার দখল করে নিয়ে ৯ মে তাঁর বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ভারতে যাওয়ার পথ না পেয়ে ১০ মে বার্মায় আশ্রয় নেন। ঐখানে মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিন, ফজলুল কাদের চৌধুরী পি.ডি.বি’র নেতা মোহাম্মদুন্নবী চৌধুরী ও জহুরুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কাছে চিঠি লিখেন মন্ত্রীত্ব গ্রহণের লোভ দেখিয়ে আত্মসমর্পণের জন্যে। এই চিঠির মর্ম মতে মন্ত্রীত্বের লোভ তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীনতর পর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত-এর দায়িত্ব পালন করেন।

রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমান অবকাঠামো তাঁর দ্বারাই সৃষ্ট। কক্সবাজার জেলার নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি বিশ্বাস করেন, জাতির অর্ধেকাংশকে অন্ধকারে রেখে জাতির অগ্রযাত্রা কোন দিন শুভ হতে পারে না। তাই নারী সমাজকে আলোর জগতে আনতে হবে। ১৯৬১ সালে কক্সবাজার মহকুমার প্রথম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর পরিবারের ৫৬ শতক জমিতে নির্মিত ২টি টিনের ঘরে কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে। যার বর্তমান পরিচিতি কক্সবাজার সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তাঁরই শ্রমে ঘামে ১৯৭৬ সালে গড়ে উঠে রামু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ১৯৮২ সালে কক্সবাজার সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭৯ সাল হতে কক্সবাজার সিনেমা হলের প্রতি টিকেটে বিশ পয়সা বসিয়ে গড়ে তুলেন কক্সবাজার মহকুমা নারী শিক্ষা উন্নয়ন তহবিল। ঐ তহবিল থেকে অনুদান দিয়ে আরও নতুন নতুন নারী শিক্ষা প্রতিষ্টান গড়ার জন্যে কক্সবাজার মহকুমার সকল থানার অধিবাসীকে উৎসাহিত করেন। কক্সবাজার জেলার একমাত্র উচ্চতর নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার মহিলা কলেজ, তাঁরই উদ্যোগে শ্রমে, ঘামে গড়া।

তিনি এই কলেজের অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেগম রওশন সরওয়ার চৌধুরী এই কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে এই কারনে কক্সবাজার জেলার নারী শিক্ষা সম্প্রসারণের অগ্রদূত বললেও অত্যুক্তি হবে না।

১৯৬৯ সালে তিনি রামু বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারনে সেই কলেজ ধরে রাখতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি রামু কলেজ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। রামু কলেজ গভর্ণিং বডির প্রতিষ্ঠাতা প্রতিনিধি সদস্য ছিলেন তিনি।

ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত গর্জনীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরনো ভবনটি তাঁরই উদ্যোগে জনগণের দানে পুনঃনির্মিত হয়। কচ্ছপিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান পাকা ভবনটি তাঁরই আবেদনে ‘‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’’ কর্তৃক নির্মিত হয়।

শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সরব পদচারণা ছিল ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর। তিনি খুব বেশী লিখেননি। যা, লিখেছেন তা বিদগ্ধ গুণীজনদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। জীবনের প্রথম হতেই তিনি একজন প্রকৃত ক্রীড়ামোদি ও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। ১৯৫৯ সাল হতে ১৯৭০ পর্যন্ত তিনি জেলার প্রখ্যাত রামু টিমের নেতৃত্বে ছিলেন। অনেক ট্রফি জিতেছেন। তিনি কক্সবাজার জেলা রেফারিজ ও আম্পায়ার্স এসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি একজন ভাল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড ছিলেন। তিনি ১৯৬১ সালে কেরামে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রানার্স আপ ছিলেন।

রাজনীতি যাঁরা করেন সাধারণত; তাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখা যায়না। কিন্তু ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যতিক্রম চরিত্রের মানুষ। ছাত্র জীবন থেকে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তাঁরই উদ্যোগে রামুতে প্রথম মহান শহীদ দিবস ১৯৫৯ সালে পালন করা হয়। ১৯৬১ সাল হতে প্রথম কক্সবাজার মহকুমা সদরে ঐ দিবসটি পালন করা হয়। কক্সবাজার মহকুমায় প্রথম গীতিনক্সা ‘‘জন্মভূমি’’ তাঁরই রচনা ও পরিচালনায় মঞ্চায়ন করা হয়।

১৯৫২ সাল হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ নিয়ে তাঁরই রচনা, গ্রন্থনা, পরিচালনা ও অভিনয়ে রামু দূর্বার শিল্পীগোষ্ঠীর গীতিনৃত্য নাট্য ‘দুর্জয় বাংলা’ কক্সবাজার চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চায়ন করা হয়। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিজয় মেলায় রামুর প্রয়াত কবি আশীষ কুমার বড়–য়া রচিত গণগীতি নৃত্য নাট্য ‘‘মরশালা পাবলিক’’ তাঁর পরিচালনা ও ও অভিনয়ে মঞ্চস্থ হয়।

 

পাঠকের মতামত: